হিং টিং ছট্‌ (সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ)

হিং টিং ছট্‌ (সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ)

হিং টিং ছট্‌ (স্বপ্নমঙ্গল)

স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবুচন্দ্র ভূপ,—
তার ভাবি’ ভাবি’ গবুচন্দ্র চুপ!—
শিয়রে বসিয়া যেন তিনটে বাঁদরে
উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে;
একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড়
চখে মুখে লাগে তার নখের আঁচড়।
সহসা মিলাল তা’রা এল এক বেদে,
“পাখী উড়ে গেছে” বলে’ মরে কেঁদে কেঁদে;
সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে,
ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচ্চ এক দাঁড়ে।
নীচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়্থু‌ড়ি,
হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়সুড়ি।
রাজা বলে “কি আপদ!” কেহ নাহি ছাড়ে,
পা দু’টা তুলিতে চাহে, তুলিতে না পারে।
পাখীর মতন রাজা করে ঝট্‌প‌ট্‌,—
বেদে কানে কানে বলে—“হিং টিং ছট!”
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃত সমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভণে, শুনে পুণ্যবান্!

হবুপুর রাজ্যে আজ দিন ছয় সাত
চখে কারো নিদ্রা নাই, পেটে নাই ভাত।

ADVERTISEMENT

শীর্ণ গালে হাত দিয়ে নত করি’ শিল্প
রাজ্যসুদ্ধ বালবৃদ্ধ ভেবেই অস্থির।
ছেলেরা ভুলেছে খেলা, পণ্ডিতেরা পাঠ,
মেয়েরা করেছে চুপ—এতই বিভ্রাট।
সারি সারি বসে’ গেছে কথা নাই মুখে,
চিন্তা যত ভারি হয় মাথা পড়ে ঝুঁকে।
ভুঁই ফোঁড়া তত্ত্ব যেন ভূমিতলে খোঁজে,
সবে যেন বসে’ গেছে নিরাকাব ভোজে।
মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া উৎকট
হঠাৎ ফুকারি উঠে—“হিং টিং ছট্‌।”
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃত সমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভণে, শুনে পুণ্যবান্।

চারিদিক হতে এল পণ্ডিতের দল,
অযোধ্যা কানোজ কাঞ্চী মগধ কোশল,
উজ্জয়িনী হতে এল বুধ-অবতংস—
কালিদাস কবীরে ভাগিনেয়বংশ।
মোটা মোটা পুঁথি লয়ে উলটায় পাতা,
ঘন ঘন নাড়ে বসি’ টিকিসুদ্ধ মাথা!
বড় বড় মস্তকের পাকা শস্যক্ষেত
বাতাসে দুলিছে যেন শীর্ষ-সমেত!
কেহ শ্রুতি, কেহ স্মৃতি, কেহ বা পুরাণ,
কেহ ব্যাকরণ দেখে, কেহ অভিধান;

কোনখানে নাহি পায় অর্থ কোনরূপ,
বেড়ে ওঠে অনুস্বর বিসর্গের স্তূপ!
চুপ করে’ বসে’ থাকে বিষম সঙ্কট,
থেকে থেকে হেঁকে ওঠে –“হিং টিং ছট্‌।”
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃত সমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভণে, শুনে পুণ্যবান্।

কহিলেন হতাশ্বাস হবুচন্দ্র রাজ—
ম্লেচ্ছদেশে আছে নাকি পণ্ডিতসমাজ।
তাহাদের ডেকে অনি যে যেখানে আছে—
অর্থ যদি ধরা পড়ে তাহাদের কাছে।—
কটাচুল নীলচক্ষু কপিশ কপোল,
যবন পণ্ডিত আসে, বাজে ঢাক ঢোল।
গায়ে কালো মোটা মোটা ছাঁটাছোঁটা কুর্ত্তি,
গ্রীষ্মতাপে উষ্মা বাড়ে, ভারি উগ্রমূর্ত্তি!
ভূমিকা না করি’ কিছু ঘড়ি খুলি’ কয়—
“সতেরো মিনিট মাত্র রয়েছে সময়,
কথা যদি থাকে কিছু বল চট্‌পট্‌!”
সভাসুদ্ধ বলি’ উঠে “হিং টিং ছট্‌!”
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃত সমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভযে, শুনে পুণ্যবান্!

স্বপ্ন শুনি ম্লেচ্ছমুখ রাঙা টক্‌টকে,
আগুন ছুটিতে চায় মুখে আর চখে!
হানিয়া দক্ষিণ মুষ্টি বাম করতলে
“ডেকে এনে পরিহাস” রেগেমেগে বলে!—
ফরাসী পণ্ডিত ছিল, হাস্যোজ্জ্বলমুখে
কহিল নোয়ায়ে মাথা, হস্ত রাখি বুকে—
“স্বপ্ন যাহা শুনিলাম রাজযোগ্য বটে;
হেন স্বপ্ন সকলের অদৃষ্টে না ঘটে!
কিন্তু তবু স্বপ্ন ওটা করি অনুমান
যদিও রাজার শিরে পেয়েছিল স্থান!
অর্থ চাই রাজকোষে আছে ভূরি ভূরি,
রাজস্বপ্নে অর্থ নাই, যত মাথা খুঁড়ি!
নাই অর্থ কিন্তু তবু কহি অকপট
শুনিতে কি মিষ্ট আহা—হিং টিং ছট্‌!”
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃত সমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভণে, শুনে পুণ্যবান্!

শুনিয়া সভাস্থ সবে করে ধিক্ ধিক্‌—
কোথাকার গণ্ডমূর্খ পাষণ্ড নাস্তিক!
স্বপ্ন শুধু স্বপ্নমাত্র মস্তিষ্ক-বিকার,
এ কথা কেমন করে’ করিব স্বীকার!
জগৎ-বিখ্যাত মোরা “ধর্ম্মপ্রাণ” জাতি।
স্বপ্ন উড়াইয়া দিবে!—দুপুরে ডাকাতি!
হবুচন্দ্র রাজা কহে পাকালিয়া চোখ—
“গবুচন্দ্র, এদের উচিত শিক্ষা হোক!

হেঁটোয় কণ্টক দাও, উপরে কণ্টক,
ডালকুত্তাদের মাঝে করহ বণ্টক!”
সতেরো মিনিট কাল না হইতে শেষ,
ম্লেচ্ছ পণ্ডিতের আর না মিলে উদ্দেশ।
সভাস্থ সবাই ভাসে আনন্দাশ্রুনীরে,
ধর্ম্মরাজ্যে পুনর্ব্বার শান্তি এল ফিরে।
পণ্ডিতেরা মুখ চক্ষু করিয়া বিকট
পুনর্ব্বার উচ্চারিল “হিং টিং ছট্‌!”
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃত সমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভণে, শুনে পুণ্যবান্!

অতঃপর গৌড় হতে এল হেন বেলা
যবন পণ্ডিতদের গুরুমারা চেলা।
নগ্নশির, সজ্জা নাই, লজ্জা নাই ধড়ে—
কাছা কোঁচা শতবার খসে’ খসে’ পড়ে।
অস্তিত্ব আছে আছে, ক্ষীণ খর্ব্বদেহ,
বাক্য যবে বাহিরায় না থাকে সন্দেহ!
এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়
দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময়।
জানে অভিবাদন, না পুছে কুশল,
পিতৃনাম শুধাইলে উদ্যত মুষল।
সগর্ব্বে জিজ্ঞাসা করে “কি লয়ে বিচার!
শুনিলে বলিতে পারি কথা দুই চার;

ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট্‌পালট্‌!”
সমস্বরে কহে সবে—“হিং টিং ছট্‌!”
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃত সমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভণে, শুনে পুণ্যবান্!

স্বপ্নকথা শুনি মুখ গম্ভীর করিয়া
কহিল গৌড়ীয় সাধু প্রহর ধরিয়া,
“নিতান্ত সরল অর্থ, অতি পরিষ্কার,
বহু পুরাতন ভাব, নব আবিষ্কার।
ত্র্যম্বকের ত্রিনয়ন ত্রিকাল ত্রিগুণ
শক্তিভেদে ব্যক্তিভেদদ দ্বিগুণ বিগুণ।
বিবর্ত্তন আবর্ত্তন সম্বর্ত্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী।
আকর্ষণ বিকর্ষণ পুরুষ প্রকৃতি
আণব চৌম্বক বলে আকৃতি বিকৃতি।
কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্ম বিদ্যুৎ
ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভূত।
ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট—
সংক্ষেপে বলিতে গেলে “হিং টিং ছট্‌!”
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃত সমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভণে, শুনে পুণ্যবান্!
সাধু সাধু সাধু রবে কাঁপে চারিধার,
সবে বলে—পরিষ্কার—অতি পরিষ্কার!

দুর্ব্বোধ যা কিছু ছিল হয়ে গেল জল,
শূন্য আকাশের মত অত্যন্ত নির্ম্মল!
হাঁপ ছাড়ি উঠিলেন হবুচন্দ্র রাজ,
আপনার মাথা হতে খুলি লয়ে তাজ
পরাইয়া দিল ক্ষীণ বাঙ্গালীর শিরে,
ভারে তার মাথাটুকু পড়ে বুঝি ছিঁড়ে’!
বহুদিন পরে আজ চিন্তা গেল ছুটে,
হাবুডুবু হবু রাজ্য নড়ি চড়ি উঠে।
ছেলেরা ধরিল খেলা, বৃদ্ধেরা তামুক,
এক দণ্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ।
দেশযোড়া মাথাধরা ছেড়ে গেল চট্‌,
সবাই বুঝিয়া গেল—হিং টিং ছট্!
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃত সমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভণে, শুনে পুণ্যবান্!


যে শুনিবে এই সপ্নমঙ্গলের কথা,
সর্ব্বভ্রম ঘুচে যাবে নহিবে অন্যথা।
বিশ্বে কভু বিশ্ব ভেবে হবে না ঠকিতে,
সত্যেরে সে মিথ্যা বলি’ বুঝিবে চকিতে।
যা আছে তা নাই, আর, নাই যাহা আছে,
এ কথা জাজ্জ্বল্যমান হয়ে তার কাছে।
সবাই সরলভাবে দেখিবে যা কিছু,
সে আপন লেজুড় জুড়িবে তার পিছু।

এস ভাই, তোল হাই, শুয়ে পড় চিত,
অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত—
জগতে সকলি মিথ্যা সব মায়াময়
স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃত সমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভণে, শুনে পুণ্যবান্।

 

১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৯


0 comments

Sanwal

Sanwal

Shared publicly - 18th May, 22 02:18 am

test comments

Anamika Mandal

Anamika Mandal

Shared publicly - 18th May, 22 02:14 am

Good C

Anamika Mandal

Anamika Mandal

Shared publicly - 18th May, 22 02:09 am

Good B

Anamika Mandal

Anamika Mandal

Shared publicly - 18th May, 22 02:09 am

Good A

Anamika Mandal

Anamika Mandal

Shared publicly - 18th May, 22 02:07 am

Good

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait